শিক্ষণীয় একটি গল্প
![]() |
শিক্ষণীয় একটি গল্প |
আমি একমাত্র ছেলে। আমার জন্মের কিছুদিন পরই সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা যান। মা আর নানা নানু আমাকে বড়ো করে তোলেন। মা স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন।
আমার বিয়ের দুই বছর পর যখন আমি সদ্য জন্মানো একটি ছেলে সন্তানের বাবা, তখন আমার জীবনে একটা অকল্পনীয় ঘটনা ঘটলো। আমি জানলাম, আমার বাবা জীবিত।
এক রাতে নানু আমাকে তার রুমে ডেকে মা বাবার জীবনের কথা বললেন।
তাদের ঘটনাটি এরকমঃ
মা বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। মার সাথে বাবার যখন সম্পর্ক হয়, তখন মা চাকরি করতেন। কিন্তু বাবা বেকার ছিলেন। বাবা চাকরি খুঁজছিলেন, কিন্তু পাচ্ছিলেন না। মাও বাবার জন্য চাকরি খুঁজতেন। কারণ ছেলে বেকার শুনলে নানা নানী হয়তো বিয়েতে রাজী হবেন না।
এক সময় বাবা একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির খোঁজ পেলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, চাকরিটা পেতে হলে বড়ো অংকের টাকার প্রয়োজন ছিলো। বাবার পক্ষে সে টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিলো না। কারণ বাবার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। মা তখন বাবাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন।
মার জমানো টাকা ছিলো। কিন্তু ঐ টাকা দিয়েও যখন হচ্ছিলো না, মা তখন ব্যাংক থেকে লোন নিলেন। অবশেষে মার টাকা দিয়ে বাবার চাকরি হয়ে গেলো।
তারপর পারিবারিক ভাবে বাবা মার বিয়ে হলো। মা শ্বশুরবাড়ি চলে এলেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে মা স্কুলে যাতায়াত করতেন। এক সময় মার পেটে আমি এলাম।
আমার জন্মের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, বাবা তখন মাকে বললেন,"এখানে তোমার দেখার কেউ নেই। মা অসুস্থ মানুষ। তার পক্ষে তোমাকে দেখা সম্ভব নয়। তুমি বাবার বাড়ি চলে যাও। আমি নিয়মিত গিয়ে খোঁজ নেবো।"
মা বাবার বাড়ি চলে এলেন। মাকে দেখার জন্য বাবা নিয়মিত আসতেন। আমার জন্মের দিনও বাবা এসেছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে বাবা আসা বন্ধ করে দিলেন। তখন মোবাইল ফোন ছিলো না। তাই ফোনে বাবার সাথে যোগাযোগ করার উপায় ছিলো না।
মা শ্বশুরবাড়ি গিয়েও বাবার খোঁজ পান নি।
মার শাশুড়ি অর্থাৎ আমার দাদী মাকে বলেছিলেন, ছেলে এখন বাসায় থাকে না। কোথায় থাকে তিনিও জানেন না।
মাস কয়েক পর মা জানতে পারলেন, বাবা গোপনে আরেকটা বিয়ে করেছেন। যাকে বিয়ে করেছেন তিনি বাবার অফিসের কলিগ ছিলেন। বাবা হুট করে কলিগকে বিয়ে করেন নি। গোপনে অনেকদিন প্রেম করেছিলেন।
বাবার এই বিশ্বাসঘাতকতা মা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেন নি। যাকে তিনি শূন্য থেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেই মানুষটা কী করে এমন করতে পারলেন?
মার আঘাত পাওয়া এখানেই শেষ হয় নি। আরো বাকি ছিলো।
মা একদিন আমাকে কোলে নিয়ে বাবার দ্বিতীয় সংসারে হাজির হলেন। বাবার বদলির চাকরি ছিলো। বাবা তখন অন্য জেলায় থাকতেন।
মা বিস্ময় নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,"তুমি আমার সাথে এমন কেনো করলে?"
বাবা উত্তরে মাকে তুই সম্বোধনে বললেন,"তুই নষ্টা মেয়ে। তোর এই ছেলের বাবা আমি না। তোর সাথে সংসার করার প্রশ্নই আসে না। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি।"
বাবা ভালো করেই জানতেন, আমি তার সন্তান। আর মায়ের চরিত্রেরও কোনো সমস্যা ছিলো না। তবু বাবা মাকে দোষ দিয়েছিলেন তার দ্বিতীয় বিয়েকে বৈধতা দেয়ার জন্য।
বাবার মিথ্যা অপবাদ শুনে মা চিৎকার চেঁচামেচি করেন নি। শুধু অবিশ্বাস নিয়ে বাবার দিকে চেয়েছিলেন। মা সেদিন কতোখানি আঘাত পেয়েছিলেন, তা ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমাকে নিয়ে মা বাড়ি ফিরে এলেন। সেদিনই মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাকে বাবার কথা কোনোদিন বলবেন না। আমাকে বলবেন, বাবা মারা গেছেন। আর আমি সেটা জেনেই বড়ো হলাম।
মার ফিরে আসার কিছুদিন পরই বাবা মার তালাক হয়ে গেলো।
এটুকু বলার পর নানু বললেন,"ঘটনা এখানেই শেষ হয় নি। আরো বাকি আছে। সেটা আগামীকাল তুমি জানতে পারবে।"
সারারাত আমার ঘুম হলো না। গোটা রাত বাবা মার কথা মাথায় ঘুরতে লাগলো।
পরদিন মা আমাকে বাবার বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাবা নেই এটা জেনে আমি বড়ো হয়েছি। তাই বাবার প্রতি বিশেষ কোনো টান আমার মধ্যে ছিলো না। শুধুমাত্র কৌতূহলবশত বাবাকে দেখতে গেলাম।
আমি আর মা ড্রইং রুমে বসেছিলাম। খানিক পর বাবা রুমে এলেন। বাবাকে দেখে চমকে গেলাম। তিনি হুইলচেয়ারে বসে আছেন। রোগে জর্জরিত শীর্ণ শরীর। তিনি এতোটাই দুর্বল ছিলেন যে, হুইলচেয়ার চালানোর শক্তি তার ছিলো না। অন্য একজন মানুষ হুইলচেয়ার ঠেলে বাবাকে রুমে এনে দিয়েছিলেন।
বাবা কম্পিত কণ্ঠে যা বললেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
বাবা বললেন, যেদিন মা আমাকে কোলে করে তার বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন, ঠিক সেদিন থেকে তার জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছিলো।
সেদিন রাত থেকে তিনি শারীরিক মিলনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু লাভ হয় নি। এক সময় দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। এতে তিনি দমে না গিয়ে আরো একটা বিয়ে করলেন। কিন্তু এই স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। এবার তিনি ভেঙে পড়লেন। তিনি তখন বুঝতে পারলেন, তার জীবন আর আগের মতো নেই। সেই যে ভেঙে পড়লেন, আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না। তারপর একের পর এক রোগে তিনি আক্রান্ত হতে লাগলেন। এখন জীর্ণ শরীরে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন।
এতোদিন পর আমাকে বাবার কথা বলা এবং বাবাকে দেখতে নিয়ে আসা বিনা কারণে ছিলো না। মা কেনো হঠাৎ এ কাজটা করলেন তা আমার বুঝতে সমস্যা হয় নি।
মাস ছয়েক হবে আমি এক নারীর সাথে গোপন সম্পর্কে জড়িয়েছি। কিছুদিন হলো স্ত্রী সেটা ধরতে পেরেছে। তখন থেকে ওর সাথে ঝগড়া হতে লাগলো।
একদিন রেগে গিয়ে ঠিক বাবার কথাগুলো স্ত্রীকে বললাম,"তুই নষ্টা মেয়ে। তোর এই ছেলের বাবা আমি না। তোর সাথে সংসার করার প্রশ্নই আসে না। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবি।"
আমার আর বাবার কথা অবিকল মিলে গেলো দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আরো ভয় পেলাম এই দেখে, বাবা যখন মাকে মিথ্যা চরিত্রের দোষ দিয়েছিলেন, তখন আমার বয়স ছিলো চার মাস, আর আমি যখন আমার স্ত্রীকে মিথ্যা চরিত্রের দোষ দিয়েছিলাম, তখন আমার সন্তানের বয়সও ছিলো চার মাস।
এতোখানি যখন মিলেছে তার মানে আমার সাথে বাবার করুণ পরিণতিও অবিকল মিলবে। আমি আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
বাবার বাড়ি থেকে বেরুনোর পর মা শান্ত গলায় আমাকে বললেন,"তোমার স্ত্রী খুবই ভালো একটা মেয়ে। তাকে কষ্ট দিও না।"
সেদিন রাতে স্ত্রীর হাত ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম।
গল্পটি শেষ করার আগে কোরআনের একটা আয়াত বলিঃ
সুরা নূর এর ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,"যারা সতী সাধ্বী সরলমনা নারীদের ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।"
কোন মন্তব্য নেই