ম্যাচ শেষ হবার পর, টিভির সামনে প্রায় ১ ঘন্টা অপেক্ষা
![]() |
ম্যাচ শেষ হবার পর, টিভির সামনে প্রায় ১ ঘন্টা অপেক্ষা |
ম্যাচ শেষ হবার পর, টিভির সামনে প্রায় ১ ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। ভারতীয় দলের বিদায়ী কোচ, ক্যাপ্টেনের কোথাও যদি বক্তব্যে টুকরো টুকরো হীরের সন্ধান পাওয়া যায় এই আশায়। যেমনটা ১৯ শে নভেম্বর ২০২৩ এ পেয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে পরলো, সেদিন ছিলাম আমরা রানার আপ, আজ চ্যাম্পিয়ন। ভারতের কোচ বা ক্যাপ্টেনের বিদায়ী বক্তব্য শোনার জন্য হয়তো সাংবাদিকদের আরো কয়েক ঘন্টা চাতক পাখির মতো বসে থাকতে হয়েছে। আসছে না দেখে ১৯ শে নভেম্বর রাতের মতো হতাশ হয়ে শুতে যাইনি। ২৯ শে জুন, রাত প্রায় পৌনে দু'টো নাগাদ একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বিছানায় মাথা দিয়েছিলাম।
কেন জেগে ছিলাম রাহুল দ্রাবিড় বা রোহিত শর্মার পোস্ট ম্যাচ প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য শোনার জন্য?
২০০৪, জর্জ ডব্লিউ বুশ তাঁর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নমিনেশন ফাইল জমা দিয়েছেন। প্রতিপক্ষ ছিলেন ডেমোক্রেটিকের জন কেরি। জর্জ বুশের দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকাতে তিনি এতটাই মরিয়া ও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, বুশের কাছে পরাজিত হয়ে প্রথম সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরের বলেন, "আমাকে ছেড়ে দিন। আজ আমি একটাই মাত্র স্পিচ রেডি করে এসেছিলাম"। নাছোড় সাংবাদিক তবুও বললেন জেতার ব্যাপারে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন? এবার জন কেরি তাঁর ফাইল থেকে কিছু কাগজ দেখিয়ে বললেন, "দেখুন আমি এই স্পিচটাই রেডি করে এনেছিলাম। অন্য কিছু নিয়ে আসিনি..."
আমার কেন জানি না সেই কথাটাই বারবার মনে হয়েছিল, রাহুল দ্রাবিড় কি এরকম কোন স্পিচ রেডি রেখেছিলেন? যেখানে শুধুমাত্র জেতার স্পিচটাই নোটবুক করা ছিল। হয়তো ছিল! হয়তো বা ছিল না!!
গতকাল ম্যাচে কোনটা ভাইটাল?
টসে জিতে ব্যাটিং? বিরাট কোহলি আর অক্ষর প্যাটেলের ঐ কেমিস্ট্রি ? নাকি যে কোহলি আর দুবে কে নিয়ে গোটা টুর্নামেন্ট সমালোচনা সেই দুজনেরই ক্লিক করে যাওয়া? নাকি বুমরার ১৭ তম ওভারে অবিশ্বাস্য স্পেল? নাকি সূর্য কুমার যাদবের ওই অতিমানবীয় ক্যাচ? নাকি হার্দিক পান্ডিয়ার ক্লাসেনের ১৬ তম ওভারে প্রথম বলেই উইকেট নেওয়া? কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবেন?
রোহিত গুরুনাথ শর্মা। উনিশে নভেম্বরের পর চার দিন বাদ তাঁর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিও টা ভাইরাল করে তাঁর মেয়ে। দেখা যায় রোহিত তনয়া বলছে, "পাপা আভি ভি রো রাহা হ্যায়...."। সেই রোহিত আবারো কাঁদেন, ২৭ জুন রাত। যেদিন তাঁর নেতৃত্বে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে একবছরে তৃতীয়বার কোন আইসিসি টুর্নামেন্টর ফাইনালে উঠলো। গত সাড়ে তিন বছর ধরে যাবতীয় আলোচনা- সমালোচনা ঝড় ঝাপটা সামলে রাখার প্রতিদান পেলেন বার্বাডোজে তেরঙ্গা ঝান্ডা পুঁতে। ৩৬ বলে ৫৪ থেকে, ৩০ বলে ৩০ চলে আসা উইনিং প্রেডিকশন ৯২-৮ হয়ে যাওয়া প্রায় একপেশে ম্যাচটাকে স্রেফ হিমশীতল মাথা ঠাণ্ডা রেখে ম্যাচ বের করার ক্যাপ্টেনের নাম রোহিত গুরুনাথ শর্মা। বচনবাগিস পাকিস্তান প্রেমী নবজত সিং সিধু পর্যন্ত বলে ফেললো, "যাদের হার্ট দুর্বল, তাদের এই ম্যাচ কখনোই দেখা উচিত না...." । আর এই ম্যাচকে রোমহর্ষক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার নাম রোহিত শর্মা। বিশ্বকাপ জেতা কপিল দেব, মহেন্দ্র সিং ধোনির পর তৃতীয় ক্যাপ্টেন হিসেবে এবার রোহিত শর্মার নাম এক ফ্রেমে লেখা থাকবে। আজ আশা করছি রোহিত তনয়া আর বলবে না, "পাপা আভি ভি রো রাহা হ্যায়..."।
"বিরাট কোহলি দ্য এ্যরা"- নাহঃ, অন্তত কাল থেকে চিন্তা করে আমার দেখা এখনো পর্যন্ত এমন কোন ইনিংস মনে পরছে না, গোটা টুর্নামেন্টে একপ্রকার নিস্প্রভ থেকে ফাইনালেই অবিস্মরণীয় ইনিংস খেলে সেই ম্যাচের "ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ" হয়েছেন। অবিশ্বাস্য পরিণতি দেখালেন ইনিংস বিল্ড আপ করতে। একই রকম অবিশ্বাস্য লাগে শুনতে, যখন শুনি, গলি ক্রিকেটে না খেলা ব্যক্তিও ক্রিকেটকে অলিম্পিক যুক্ত করা একটা সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজনকে যখন ক্রিকেট খেলার জ্ঞান দেয়। এটা এক একমাত্র এই ভারতবর্ষেই সম্ভব। কিছুদিন আগেই মোহাম্মদ সামি এক টিভি চ্যানেলে বলেছিলেন, "ভাগ্যিস বিরাট কোনো বোলার হয়নি, না হলে ও কি করত ও নিজেও জানে না। উইকেট পেলাম আমি, আর বিরাট, আমার উইকেট পাওয়ার সেলিব্রেশন করছে স্ট্যাম থেকে এতোটা(হাত দিয়ে দেখিয়ে) লাফিয়ে...."। সেই আগ্রাসনকে কন্ট্রোলে রেখে কাল বিরাট কোহলি নামক হাল্কেরও চোখের পাতা পিটপিট করছে আবেগে। বয়স হলে মানুষের ম্যাচিউরিটি অনেকটাই বেড়ে যায় বিরাট কোহলির কনভারসেশন সেটাই বলে দেয়। কি বললেন? ধন্যবাদ দিলেন তার টিম ম্যানেজমেন্টকে। সর্বোপরি কোচ এবং ক্যাপ্টেনকে যারা বারবার আশ্বাস দিয়েছে তুমি আমাদের সাথেই থাকো। আমরা তোমার উপর আশ্বাস হারাইনি। সেই প্রতিদানেই কি নিজে ট্রফিটা কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের হাতে তুলে দিয়ে দিলেন?
আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের বোলারদের কোনদিন বল করতে দেখিনি। যারা দেখেছেন, তাঁরা যদি আজ বেঁচে থাকেন, তারাও স্বীকার করবেন জসপ্রিত বুমরাহ আজকের দিনে সেই চারেদের মধ্যে জায়গা করে নিতেন। কি অ্যাকিউরেসি! কি সব বৈচিত্র্য! আমার দেখা ওয়াসিম আক্রমের থেকেও ভার্সেটাইল। চাপের মুখে অবিশ্বাস্য ভাবে দিনের পর দিন একই কন্সিটেইনসি দেখিয়ে গেছেন।
আর ,
এন্ড অব দ্যা এ্যরা, রাহুল শারদ দ্রাবিড়।
এ্যরা কেন? রাহুল দ্রাবিড়ই বিশ্বের একমাত্র কোচ, যিনি এক বছরের মধ্যে তাঁর কোচিং এ তিন তিনটে আইসিসির টপ মোস্ট ইভেন্টের ফাইনাল তুললেন। একটা টিমের কতটা ভেরিয়েশন থাকলে এইভাবে পারফর্ম করা যায়? সেই কৃতিত্বের সিংহভাগ অবশ্যই রাহুল দ্রাবিড় করতেই পারেন। কি রকম ছিল সেই ভেরিয়েশন?
বাংলাদেশের সাথে পোস্ট ম্যাচ প্রেস কনফারেন্সে রোহিত শর্মা জানালেন, তাদের ১৯৬ রানের মধ্যে মাত্র একজনের ৫০ হয়েছে। বাকিরা ২০-৩০ করেছে। আর এই যে রানটা হয়েছে দেখুন, প্রত্যেকের যে রোল ছিল সেই রোলটা প্রত্যেকে এক্সিকিউট করেছে। এটাই আমাদের টিম হিসেবে সাফল্য। আর এই যে, "আমি নয় আমরা" এই বন্ধনীর মধ্যে সবাইকে বেঁধে দেওয়া, তিনি আর কেউ নন, রাহুল শারদ দ্রাবিড়। একটা সময় সঞ্জয় মঞ্জেরেকর শচীন তেন্ডুলকারকে "সাদা হাতি" বলেছিলেন। সঞ্জয়ের অভিযোগ ছিল সচিন তেন্ডুলকারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। বাকি ক্রিকেটারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। যার ফলে ড্রেসিংরুম প্রায় দু'ভাগ হয়ে গিয়েছিল সে সময়। দুর্ভাগ্যবশত কোচের নাম সম্ভবত অজিত ওয়াদেকর, অংশুমান গায়কোয়ার। চার বছর আগে রাহুল যখন দায়িত্ব নেন তখনও ড্রেসিংরুমের মধ্যে রোহিত আর বিরাট নিয়ে "প্রকাশ্য দুর্গন্ধ" ছড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে, সেই দুর্গন্ধ কে সুগন্ধে পরিণত করেন এই দ্রাবিড়। যার ফলেই, সেই সময় রোহিতের অফ ফর্মে বিরাট পাকিস্তানী সাংবাদিকদের ধুইয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, "টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে রোহিত শর্মাকে বসাতে চান আপনি? আপনার মাথাটা ঠিক আছে তো...."( যে ভিডিও আমি আগেই দেখিয়েছি)। এই বাঁধন দেওয়ার কারিগরের নাম অবশ্যই রাহুল দ্রাবিড়। এই রাহুল ক্রিকেটার হিসেবে যতটা সম্মান প্রাপ্য ছিলেন ততটা তিনি কখনোই পাননি। তাই স্বয়ং ক্রিকেট দেবতাও কিছুতেই চাননি ক্লাসেনের ওই দানবীয় ইনিংস খেলার পরও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপটা নিয়ে যাক। সেই জন্যই হয়তো আজকে সূর্য কুমারকে অতিদানবীয় করে তুললেন। তাঁর ক্যারিয়ার যেন জৌলুষ হীন যেন না হয়ে যায়। রোহিত - বিরাটের মতো রাহুল দ্রাবিড়েরেও খুবই দরকার ছিল নিজের অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার।
২৯ শে জুন, ২০২৪ সেই রাত। যেখানে ভারতের বিশ্বজয়ের পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেটে তিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আশ্চর্যজনক ভাবে একই সময়ে বিদায় (T20 র ক্ষেত্রে ) জানালেন।
ভালো থাকুক রোহিত -রাহুল- বিরাটরা। ভালো থাকুক আগামীর ভারতীয় ক্রিকেট
।
কোন মন্তব্য নেই